যদিও কল্পনা করা সম্ভব না, তবু একটু চেষ্টা করুন। ফিফটিন্থ ডাইনেস্টি অফ ইজিপ্ট চলে তখন ; ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম নেওয়ার প্রায় দেড়হাজার বছর আগের কথা! উঁচু একটা জায়গা, জড়ো হয়েছে প্রচুর মানুষ, যেন কোনো উৎসব। মধ্যমনি হয়েছে বিশাল এক ডেগ। সেখানে গত পাঁচদিন ধরে জ্বাল হচ্ছে ১৫ টা প্রাকৃতিক উপাদান। চারিপাশ সুবাসে ম ম করছে ; ডেকচিকে ঘিরে লোকসমাগম ক্রমশ বেড়ে চলেছে! সেদিনও পুরোটা চলে গেলো এবং রাতের বেলা ডেগ থেকে ঘন “জিনিস” ঢালা হলো পাথর খোদাই করে বানানো খুব সুন্দর বোতলগুলোয়৷ আগামী ৩৬৫দিন একে ব্যবহার করা হবে ধর্মীয় সব কাজে এবং চিকিৎসায়। জিনিসের নামঃ Kyphi !
মিশরীয়রা ছিলো যাকে বলে সত্যিকারের ঘ্রাণপাগল৷ মিষ্টান্ন আর শরবতগুলায় ঘ্রাণউপাদান মিলাতো সবসময়, জুম্মাবারে একসাথে হয়ে “ফ্লেভার্ড ক্রিম” মাখতো সারা শরীরে এবং মাথায় ! ক্রিম বলতে আমরা যেই অয়েন্টমেন্ট মাখি ক্ষতস্থানে, ওইরকম ঘন পেস্ট ; শুদ্ধভাষায় বলতে চাইলে Unguent. বেশ কয়েকটা “সিগ্নেচার পারফিউম” ছিলো সেই সময়ে, বাহারি নামেঃ Psagdi, Qam’ey Ointment, Mendesium, Metopirum, Cyprinum ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে, সবচাইতে পছন্দের আর জনপ্রিয় ছিল যেটা, তার নাম… Kyphi !
মিশরীয়রা প্রধানত ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোয় এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে কাইফিকে ব্যবহার করত। যকৃৎ , ফুসফুসের চিকিৎসায় এর ব্যবহার ছিল উল্লেখ করার মত ! মিশরীয় সভ্যতার অনেক কবি, গুণীজনেরাই গেয়েছেন এর স্তুতি। কাইফি-তে মুগ্ধ হয়ে গ্রিক ইতিহাসবেত্তা Plutarch তো বলেই ফেলেছেন, “ওহ কাইফি.. তোমার ঘ্রাণ যেন মনোরম এক সঙ্গীত, রাতে তুমি হও পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত, ঘুমে আনো প্রশান্তি এবং উপশম করো দুশ্চিন্তা, স্বপ্নগুলো হয়ে উঠে মধুর চেও মধুর…!”
আচ্ছা, মাঝখানে কেটে গেছে তিনহাজার বছরের চাইতেও বেশি, এখন কি কাইফি-কে বানানো সম্ভব? সবকয়টা উপাদান কি এখন পাওয়া যায়? আর, তখনকার মানুষের পছন্দ কি আমাদের এখনকার সাথে মিলবে? জটিল তিনটা প্রশ্ন, উত্তর দিচ্ছি ধীরেসুস্থে। পয়েন্ট আকারে বলিঃ
(১) আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে Manetho নামের এক মিশরীয় পাদ্রী Kyphi এর প্রস্তুতপ্রণালী বিষয়ক এক শাস্ত্র লিখে যান, যদিও এর কপি পরবর্তীতে সংরক্ষিত হয় নি। কাইফি’র রেসিপি মূলত পাওয়া যায় মিশর এর Edfu, Philae মন্দিরগুলোর দেয়ালে খোদাইকৃত লিপি থেকে। মোট চারজন সুপ্রাচীন ইতিহাসবেত্তা Galen, Dioscorides, Plutarch আর Damocrates থেকে চারটা প্রস্তুতপ্রণালি পেয়েছি কাইফি’র। রেসিপি বলতে আসলে উপকরণের ওজনে না, উপকরণ সংখ্যায় তফাৎ। প্লুটার্চেরটায় ১৬ উপাদান, আরেকজন বলে ১৪। মূলকথা একই, সব উপাদান সমান পরিমাণে গিয়ে গুড়া করে জ্বাল দাও ৫দিন !
তবে গত দুইশ বছরের মধ্যে কাইফি নিয়ে সবচে বেশি গবেষণা যিনি করেছেন, সেই ‘ভিক্টর লরেট’ এর দেওয়া উপাদান-তালিকা সবচাইতে পারফেক্ট আর ব্যালেন্সড লেগেছে। কাজে লেগে গেলাম সেটা নিয়েই।
(২) জ্বি, পাওয়া যায় এখনো। আগেই বলেছি, কাইফি’র ঔষধি গুণাগুণ ছিলো প্রচণ্ড, তার মানে উপাদানগুলোর বৈশিষ্ট্য। এই এতো বছর পরেও আয়ুর্বেদে কাইফি’র কিছু কিছু উপাদান ব্যবহৃত হয় আলাদা করে।
রেসিপিতে প্রতিটা উপাদানের তখনকার নাম বলা ছিলো৷ আমরা শুরুতে তাদের বর্তমান নাম উদ্ধার করলামঃ ক্যালামাস, মির, সাইট্রোনেলা, লেমনগ্রাস, ক্যাসিয়া, সিনামন, পেপারমিন্ট, রোজউড, সাভিনউড, হেনা, নাগারমোথা, তেরেবিন্থ, মাস্টিক এবং মধু। (রেসিপিতে মদের কথা বলা ছিল, সেটা আমরা দিইনাই)
এরপরে নিজেরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে কয়েকটি আয়ুর্বেদ ও এসেনশিয়াল অয়েল উৎপাদক প্রতিষ্ঠান থেকে যোগাড় করে আনলাম ১৩ রকমের উপাদান৷ সুন্দরবনের খাঁটি মধু ব্যবহার করেছি শেষ উপাদান হিসাবে৷
(৩) এটাই সবচে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো এবং এখানেই আমাদের সবচে বড় এচিভমেন্ট লুকায়ে আছে। ঘ্রাণের ব্যাপারটা পরে আসি, কাইফি-কে কোন ফর্মে উপস্থাপন করবো সেটা নিয়ে চিন্তা করেছি অনেক। অরিজিনাল কাইফি ছিলো ক্রিম ফর্মে, কখনোবা মাউথফ্রেশনার হিসেবে সলিড আকারেও বানানো হতো একে। এখনকার মানুষকে যদি ক্রিম আকারে পারফিউম দিয়ে বলি, ভাই মাখেন পুরো শরীরে, মারবে না আমায় ধরে ?!
তাই বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, লিকুইড ফর্মে আনবো। বিধ্বংসী কেন?? আসল রেসিপিতে ন্যাচারাল উপাদানগুলোর “সলিড” ফর্ম নিয়ে কাজ করা হয়েছে, তাই প্রত্যেকটা সমান পরিমাণে দিলেও সমস্যা হয়নি, কেউ কারো উপরে উঠতে পারেনাই। কিন্তু আমি কাজ করবো উপাদানগুলোর এসেনশিয়াল অয়েল নিয়ে, সব উপাদান থেকে ত সমান পরিমাণ এসেনশিয়াল অয়েল বের হয়না! উদাহরণ দিলে আমার আতংকটা বুঝে আসবে আপনারোঃ ১কেজি ক্যালামাস ফুল থেকে এসেনশিয়াল অয়েল বের হয় ৫০ গ্রাম, কিন্তু ১কেজি পেপারমিন্ট থেকে বের হয় মাত্র ৩ গ্রাম!! যদি “আরেহ সমান সমান দিতে হবে সবকয়টা উপাদান” রেসিপি ফলো করে ৫০গ্রাম ক্যালামাস আর ৫০ গ্রাম পেপারমিন্ট এসেনশিয়াল অয়েল মিলাতাম, ধ্বংসের কিছু বাকি থাকত কি? চমৎকার ঘ্রাণটা রূপ নিতো ঝাজালো কিছুতে!
তাই আমরা প্রতিটা উপাদানের “পারসেন্টেজ ইল্ড অফ এসেনশিয়াল অয়েল” বের করেছি লিটারেচার ঘেটে এবং সেই অনুযায়ী রেসিপিকে মোডিফাই করেছি। চৌদ্দটা উপাদানকে একসাথে মিলিয়ে ম্যাচিউর করেছি তাপমাত্রা কমবেশি করে, এবং এখন বোতলজাত করে উপস্থাপন করেছি আপনাদের সামনে!
আমরা স্বজ্ঞানে একফোটা ক্যামিকালও ব্যবহার করিনি এতে। একদম কনসেন্ট্রেটেড লিকুইড হিসেবে আছে কাইফি এখন, পানির চাইতে সোয়াগুণ ঘন। এমনকি কোনোরকমের ক্যারিয়ার অয়েলও ব্যবহার করিনি, এতটাই পিওর সে!
ঘ্রাণ কেমন? কড়া ধাচের পুরোপুরি প্রাকৃতিক বাস্নাওয়ালা। স্কিনে লাগালে রাব করার আগে গ্রাসি একটা ফিলিংস আসে, গরম থাই স্যুপের স্মেল যেন! হালকা ডললেই খেলা শুরু করে মেহেদিপাতা’র শরীর ঠান্ডা করা সবুজ ঘ্রাণ, সাথে রোজউডের হালকা উডি টোন + মির এর আধ্যাত্মিকতা। ঘন্টাখানেক পরে খেলা দেখায় মিডলনোটের বাকিরাঃ ক্যাসিয়া’র ফ্লাওয়ারি ভাব, সিনামনের উষ্ণ মশলা ফিল আর মাস্টিক গামের চিউয়ি আভিজাত্য। ঘ্রাণটা শেষ হয় ভারিক্কি ভাব নিয়ে। নাটগ্রাসের আগর-নকলের প্রচেষ্টা, মধুর মিষ্টত্ব আর সাভিনউডের হালকা উডি-মিন্টি ধক্ব!
প্লিজ, ঝোঁকের বশে কিনবেন না। ঠান্ডা মাথায় দুইবার পুরো লেখা পড়ে এরপরে অর্ডার করুন। প্রতিনিয়ত ব্যবহারের জন্যে নয় অবশ্যই, অকেশনাল ইউজ এবং সংগ্রহে রাখার জন্যে। সাড়েতিনহাজার বছর আগের মানুষের চিন্তাচেতনা কেমন ছিল, তা জানার জন্য!
Leave feedback about this